[কোরআন ও বিজ্ঞান] আলোর গতি যেভাবে মাপা হয়েছিল

বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী এটা আমরা সবাই জানি যে, ট্রেন-বাস ও রকেট-বিমানের মত আলোরও একটি গতি রয়েছে। আর এই গতি এতোটাই দ্রুতগতিসম্পন্ন যে, ঘড়িতে থাকা সেকেন্ডের কাঁটাটি ঘড়ির চারপাশে ঘোরার সময় এক সেকেন্ড পরিমাণ স্থান অতিক্রম করতে করতে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত আলো প্রায় ৩২৫ বার অতিক্রম করে ফেলবে। আলো জিনিসটা এতোটাই দ্রুতগতিতে চলে যে, প্রতি সেকেন্ডে এই আলো ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ কিলোমিটার শূণ্যস্থান অতিক্রম করে থাকে। আর এই আলোর গতিবেগ যে প্রতি সেকেন্ডে ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ কিলোমিটার, সেটি জানতে বিজ্ঞানীদের এক দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। একটা সময় ছিলো যখন মানুষ জানতোই না যে, আলোর কোনো গতি আছে। পরবর্তীতে কিছুটা ধারণা জেগেছিলো বটে, তবুও একদল বিজ্ঞানীর মাঝে আলো নিয়ে ছিল বিভিন্ন ধরণের মতপার্থক্য। কেউ বলতেন আলোর কোনো গতি নেই, এটি সকল স্থানেই বিদ্যমান। কেউ বলতেন আলো আমাদের চোখ থেকে নির্গত হয়, যার ফলে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাই। কারো মতে আলোর গতি অসীম, কারো মতে আবার সসীম। এই ধরণের নানা রকম মতপার্থক্য বিরাজ করতো প্রাথমিক যুগের বিজ্ঞানীদের মাঝে।

এরপর ১৬২৯ সালে ডাচ দার্শনিক আইজ্যাক বিকম্যান একটি পরিক্ষার প্রস্তাব প্রকাশ করলেন যে, কামান থেকে বেরোনো আলোকরশ্মিকে এক মাইল দূর থেকে কোনো আয়নার মাধ্যমে প্রতিফলিত করার পর যদি দেখা যায় সেই আলো ফিরে আসতে কিছুটা সময় নিচ্ছে, তাহলে বুঝে নিতে হবে আলোর গতি আছে। কিন্তু এই পরিক্ষাটি কেউ করে দেখেনি তখন।

তার প্রায় ৯ বছর পর ১৬৩৮ সালে ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও সর্বপ্রথম আলোর গতিবেগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন একটি ভিন্ন পরিক্ষার মাধ্যমে। তিনি এক মাইল দূরবর্তী দুটি পাহাড়ের একটিতে প্রদীপ হাতে নিয়ে নিজে দাঁড়ান এবং অপরটিতে তার এক সহযোগীকে দাঁড় করান। শর্ত হলো, প্রথমজন যখন এক পাহাড় থেকে অপর পাহাড়ে আলোর সংকেত পাঠাবে, দ্বিতীয়জনও তখন সেই পাহাড় থেকে প্রথম পাহাড়ে আলোর সংকেত পাঠিয়ে সাথে সাথে আবার বন্ধ করে দিবে। এভাবে একে অপরকে আলোর সংকেত পাঠানোর পর কে কতটুকু সময়ের ব্যবধানে আলো দেখতে পেল সেটি নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার এই পরিক্ষা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। কেননা, তারা দেখতে পেলেন আলো প্রায় সাথে সাথেই এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যাচ্ছে। ফলে এই পরিক্ষায় তিনি ব্যর্থ হোন।

পরবর্তীতে ১৬৭৬ সালে ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার সর্বপ্রথম আলোর গতিবেগ নির্ণয়ে সফলতা অর্জন করেন। তিনি বৃহস্পতি গ্রহের আইয়ো নামক একটি উপগ্রহের গ্রহন পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করতে সক্ষম হোন। তার এই নির্ণয় পক্রিয়াটি বুঝতে হলে গ্রহণ কিভাবে সংগঠিত হয় সেটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে। মহাকাশের কোনো একটি বস্তু অন্য আরেকটি বস্তু দ্বারা পূর্ণ কিংবা আংশিক আড়াল হয়ে যাওয়াকেই গ্রহণ বলা হয়। ধরুণ আপনি নিস্তব্ধ বিকেলে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে আকাশপানে তাকিয়ে লালিমাবর্ণের সূর্যটার অস্তমিত হওয়ার অবস্থা মৌনাগ্রহে অবলৌকন করছেন। হঠাৎ কেউ এসে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো এবং সূর্যটা আড়াল হয়ে গেলো। যার ফলে আপনি সূর্যটাকে দেখতে পাচ্ছেন না। এটাই হলো এক প্রকার গ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ বলা যায়। তবে প্রকৃত সূর্যগ্রহণ একটু ভিন্ন। কেননা, আমরা জানি পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ আমাদের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং এই পৃথিবী আবার সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আর এগুলো যে শুধু অন্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে তা নয়, বরং নিজ নিজ অক্ষের উপরও ঘুরছে। অর্থাৎ, পৃথিবী ও চন্দ্র উভয়ই সর্বদা ঘুর্ণায়মান রয়েছে নিজ নিজ কক্ষপথে ও অক্ষের উপর।

কক্ষপথ বলতে বুঝানো হয় অন্যের চারপাশে ঘুর্ণনপথকে। আর অক্ষ বলতে বুঝানো হয় লাটিমের ন্যায় নিজস্ব ঘুর্ণনকেন্দ্রকে। চাঁদ ও পৃথিবী এভাবে স্ব-স্ব কক্ষপথে ও অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে একটা সময়ে এসে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী এই তিনটা মিলে একটি সরলরেখা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, সোজা সোজি ভাবে একই লাইনে তারা অবস্থান করে। তখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে থাকে চন্দ্র। যার ফলে পৃথিবীর মানুষের নিকট কিছুক্ষণের জন্য সূর্য দৃষ্টিগোচর হয়ে যায়। কেননা, চন্দ্র তখন সূর্যকে আড়াল করে রাখে। আর এই চন্দ্র দ্বারা সূর্য এভাবে আড়াল হয়ে যাওয়াকেই বলা হয় সূর্যগ্রহণ।

সূর্য ছাড়াও মহাকাশের অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রের গ্রহণ এভাবেই একটিকে আরেকটি দ্বারা আড়াল করার মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, কোনো একটি গ্রহণ সংগঠিত হওয়ার পর তার পরবর্তী গ্রহণটি ঠিক কখন হবে, বিজ্ঞানীরা সেটা আগেই বলে দিতে পারে। তার কারণ হলো, মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি ঘুর্ণায়মান বস্তুই নির্দিষ্ট সূত্র ধরে নিজস্ব বেগ অনুযায়ী সর্বদা আপন গতিতে ঘুরছে। তাই এগুলো ঠিক কোন সময় এসে একটিকে আরেকটি আড়াল করবে, সেটা অনেক আগেই বলে দেয়া সম্ভব। বিষয়টি সহজভাবে বুঝার জন্য আপনার হাতে বা আপনার রুমে লাগানো দেয়াল ঘড়িটা নিয়ে একটু ভাবতে পারেন।

আমরা জানি সেকেন্ডের কাঁটা ছাড়াও ঘড়িতে আরো দুটি কাঁটা থাকে। একটি মিনিটের কাঁটা, আরেকটি ঘন্টার কাঁটা। এগুলো সর্বদা তাদের নিজস্ব গতি অনুসারে অপরিবর্তনশীল অবস্থায় ঘুরে। ঘুরতে ঘুরতে যখন ১২-এর ঘরে পৌছে; অর্থাৎ যখন ঠিক ১২টা বাজে, তখন কাঁটা দুটি একসাথে মিলিত হয়ে একটিকে আরেকটি আড়াল করে দেয়। ফলে মনে হয় সেখানে একটিই কাঁটা। অথচ অপর কাঁটাটি তখন লুকিয়ে থাকে অন্যটির আড়ালে। এভাবে প্রতি ১২ঘন্টায় মোট ১১বার কাঁটা দুটি একসাথে মিলিত হয় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। এখন এভাবে এই কাঁটা দুটির মিলনাবস্থাকে যদি এক প্রকার কাঁটাগ্রহণ নামে সজ্ঞায়িত করা হয় এবং আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ঠিক কতটুকু সময় পর পরবর্তী গ্রহণটি সংগঠিত হবে? তখন আপনি কাঁটাগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হালকা একটু হিসাব করে খুব সহজেই বলে দিতে পারবেন পরবর্তী কাঁটাগ্রহণটি ঠিক কখন সংঘটিত হবে।

মহাকাশে গ্রহণগুলোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ঠিক এটাই করে। তারা টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর ঘূর্ণন গতিকে হিসেব করে পরবর্তী গ্রহণটি সংঘটিত হতে কতটুকু সময় লাগবে সেটা প্রথমে বাহির করে এবং তারপর এই সময়কাল থেকে নির্দিষ্ট দিন-তারিখটি নির্ণয় করে আগেই আমাদের জানিয়ে দেয় যে, অমুক তারিখের অমুক সময়ে সূর্য বা চন্দ্রের গ্রহণ সংঘটিত হবে। ফলে আমরা বিভিন্ন টিভি নিউজ ও পত্রিকায় চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্য গ্রহণ সম্পর্কিত তথ্য আগেভাগেই পেয়ে যাই এবং প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই গ্রহণ সংঘটিত হতে দেখতে পাই।

বিজ্ঞান কর্তৃক আগেই বলে দেয়া তথ্যানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই গ্রহণ সংঘটিত হওয়া এটা চন্দ্র ও সূর্যের ক্ষেত্রে ঠিক থাকলেও বৃহস্পতি গ্রহের আইয়ো নামক উপগ্রহের ক্ষেত্রে অনেকটা ভিন্নতা পাওয়া গিয়েছিলো। ‘আইয়ো’ প্রতি ৪২.৪৬ ঘন্টায় বৃহস্পতির চারপাশে একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। অতএব, পৃথিবী থেকে দেখা হলে, প্রতি ৪২ ঘন্টা, ২৭ মিনিট এবং ২১ সেকেন্ডে একবার ‘আইয়ো’ বৃহস্পতির আড়ালে গিয়ে গ্রহণ সংঘটন হতে দেখা যাবে। অথচ, বৃহস্পতি ও আইয়ো উপগ্রহের মধ্যকার গ্রহণ সংঘটিত হওয়ার অবস্থাকে পৃথিবীতে বসে টেলিস্কোপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেলো যে, হিসাব অনুযায়ী আইয়ো উপগ্রহের গ্রহণ ঠিক যেই সময়ে সংঘটিত হওয়ার কথা, সেই সময়ে সংঘটিত হচ্ছে না। বরং, কখনো সংঘটিত হচ্ছিলো নির্দিষ্ট সময়ের পরে, আবার কখনো সংঘটিত হচ্ছিলো সেই সময়ের আগে। বিষয়টা খুব রহস্যজনক! কেননা, উপগ্রহটির গতি যেহেতু সর্বদা একই থাকে, তাই সবসময় তার গ্রহণ একই সময় পরপর সংঘটিত হওয়ার কথা, তবুও কেন বারবার নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহণ সংঘটন হচ্ছে না এটাই ছিলো খুব রহস্যের বিষয়। ফলে ১৬৭৬ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার দিনের পর দিন ‘আইয়ো’ এর প্রত্যেকটি গ্রহণ খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি এমন একটি তথ্যের সন্ধান পান, যা পুরো বিজ্ঞান মহলকে তখন কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তার এই তথ্য দ্বারা আগে-পরে গ্রহণ সংঘটনের কারণটি ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিতর্কিত আলোর গতিকেও প্রমাণ করা হয়েছিল।

বিজ্ঞানী ওলে রোমার ‘আইয়ো’ এর গ্রহণগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন যে, আমাদের ঘূর্ণায়মান পৃথিবী নিজ কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাওয়া অবস্থায় যখন আইয়ো ও বৃহস্পতির মধ্যকার গ্রহণ সংঘটিত হয় তখন সেই গ্রহণকে কিছু সময় দেড়িতে শুরু হতে দেখা যায়। আবার যখন পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে চলে আসে তখন পূর্বের তুলনায় কিছুটা তাড়াতাড়ি গ্রহণ শুরু হতে দেখা যায়। এই বিষয়টির ব্যাখ্যা তিনি এভাবে প্রদান করেন যে, ‘আইয়ো’ এর গ্রহণ প্রত্যেকবার তার নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ীই সংঘটিত হয়, তবে সেটা পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়া যায় কিছু সময় পরে। বৃহস্পতি ও পৃথিবীর মাঝে দূরত্ব যতটা বেশি হবে, ঠিক ততোটাই দেড়িতে গ্রহণ শুরু হতে দেখা যাবে। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি এটাই প্রমাণ করেন যে, আলোর একটি নির্দিষ্ট গতি রয়েছে। কেননা, পৃথিবী যখন ঘুরতে ঘুরতে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে অনেকটা দূরে চলে যায় তখন ‘আইয়ো’ এর গ্রহণ সংঘটিত হলে সেই গ্রহণের দৃশ্যটা আলোর মাধ্যমে পৃথিবী পর্যন্ত পৌছতে আলোর গতি অনুযায়ী কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। আবার যখন পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে বৃহস্পতি গ্রহের কাছাকাছি চলে আসে তখন সেই গ্রহণের দৃশ্য পৃথিবীতে পৌছতে সময় কিছুটা কম প্রয়োজন হয়। একারণেই টেলিস্কোপের মাধ্যমে ‘আইয়ো’ এর গ্রহণ কখনো দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ের পরে এবং কখনো দেখা যায় আগে।

এটি আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য আমার পূর্বের পোষ্টটি পড়তে পারেন।

ওলে রোমার তার ব্যাখ্যার মাধ্যমে খুব সুন্দর ভাবেই আলো সম্পর্কিত পূর্বেকার মতবিরোধকে ভেঙ্গে দিয়ে সুস্পষ্টরূপে আলোর গতিকে সত্যায়ন করেন। কেননা, আলোর যদি কোনো গতি না থাকতো তাহলে পৃথিবী দূরে থাক বা কাছে থাক সর্বাবস্থায়ই গ্রহণের দৃশ্য নির্দিষ্ট সময়েই সংঘটন হতে দেখা যেত, অথচ এমনটি হচ্ছে না। যার মানে হল, আলো এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমন করতে কিছুটা সময় লাগে। আর সেই সময় হলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২,২০,০০০ কিলোমিটার। এই মানটি তিনি বের করেছিলেন বৃহস্পতি গ্রহ থেকে পৃথিবী দূরে চলে যাওয়ার দূরত্ব ও কাছাকাছি চলে আসার দূরত্বের মধ্যবর্তী দূরত্বকে ‘আইয়ো’ এর আগে পরে গ্রহণ সংঘটনের অতিরিক্ত সময় দিয়ে ভাগ করার মাধ্যমে। ওলে রোমার যদিও আলোর গতিকে খুব সুন্দর ভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তবে তখনকার সময়ে বর্তমান সময়ের মত এতো উন্নত প্রযুক্তি না থাকার কারণে তার নির্মিত মানটি ছিলো বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত মানের চেয়ে প্রায় ২৭% কম।

এরপর ১৭২৯ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ব্র্যাডলি ‘স্টেলার এবারেশন’ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে আলোর বেগ পরিমাপ করার চেষ্টা করেন। ‘স্টেলার এবারেশন’ হল পৃথিবীর গতিশীলতার কারণে দূরবর্তী নক্ষত্রের অবস্থানকে পরিবর্তিত হতে দেখতে পাওয়া। বিষয়টি সহজভাবে বুঝার জন্য সূর্যকে নিয়ে একটু ভাবতে পারেন। আমরা জানি, সূর্য একটি নক্ষত্র। আর এই নক্ষত্রের চারিদিকে আমাদের পৃথিবী ঘুরে। অর্থাৎ, সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী হলো গতিশীল, আর পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য হলো স্থিতিশীল তথা স্থির। অথচ বাহ্যিকভাবে আমরা দেখি সূর্য হলো গতিশীল। কেননা, পৃথিবীর গতিশীলতা যেহেতু আমাদের অনুভূত হয় না, তাই সূর্যকে আমাদের গতিশীল বলে মনে হয়। এটাই হলো এক ধরণের ‘স্টেলার এবারেশন’ বা ‘নাক্ষত্রিক বিকৃতি’।

এই বিকৃতি মহাকাশের দূরবর্তী নক্ষত্র গুলোতেও হয়ে থাকে। অন্ধকার রাতের ঝকঝকে আকাশে যে নক্ষত্র সমুহকে আপনি দেখতে পান, এগুলোকে দেখতে স্থির মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এমন নয়। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরার ফলে যখন পৃথিবী এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যায়, তখন পৃথিবীর স্থান পরিবর্তনের কারণে আকাশের নক্ষত্র তথা তারার অবস্থানেও পরিবর্তন সাধিত হয়। কেননা, দৃষ্টির দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে কোনো লক্ষ্যবস্তুর অবস্থানেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি আপনার শখের ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনটি দিয়ে কারো সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার একটি ছবি তুললেন এবং তাকে নিজ অবস্থানে রেখে আপনি কিছুটা ডানে বা বামে সরে গিয়ে আরেকটি ছবি তুললেন। এরপর ছবি দুটির প্রতি যখন দৃষ্টিপাত করলেন তখন দেখতে পেলেন ছবি দুটিতে লোকটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ছবি তোলার সময় লোকটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলো। এমনটি হওয়ার কারণ হলো, ছবি তোলার সময় আপনি যখন ডানে বা বামে সরে যাওয়ার কারণে আপনার অবস্থানে পরিবর্তন ঘটলো, তখন আপনার সামনে দাঁড়ানো লোকটির পেছনের দৃশ্যতেও পরিবর্তন ঘটলো, যার ফলে দুই ছবিতে লোকটিকে দুই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

স্টেলার এবারেশনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঠিক এমনই হয়। পৃথিবী যখন তার কক্ষপথ অনুসরণে এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যায়, তখন পৃথিবী থেকে তারাকে এক স্থান হতে অন্য স্থানেই পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তবে এই পরিবর্তনটি হয় বৃত্তাকারে। কেননা, পৃথিবী যেহেতু প্রতি এক বছরে সূর্যের চারিদিকে বৃত্তাকারে একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে, তাই পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে প্রতি এক বছর পরপর তারার অবস্থানেও বৃত্তাকারে পরিবর্তন হচ্ছে। যেমনটি আমরা মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে দেখে থাকি কোনো একটি পেইজ লোডিং হওয়ার সময়। এরকম দৃশ্য নাগরদোলায় উঠলেও লক্ষ্য করা যায়। নাগরদোলা যখন লোকজনকে নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে, তখন যদি নাগরদোলায় থাকা কোনো ব্যক্তি বাহিরের একটি বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তাহলে সেই ব্যক্তি উক্ত বস্তুটিকে পেছনের বস্তু সমুহের সাপেক্ষে বৃত্তাকারে ঘুরতে দেখতে পাবে। কোনো নাগরদোলাকে যদি এমন গতিতে ঘুরানো হয় যে, সেটি একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন হতে এক বছর সময় লাগবে, তাহলে বাহিরে থাকা লক্ষ্যবস্তুটিকেও এক বছরে একবার বৃত্তাকারে ঘুরতে দেখা যাবে।

পৃথিবী যেহেতু প্রতি এক বছরে সূর্যের চারিদিকে একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে, তাই কেউ যদি পৃথিবী থেকে একটি তারাকে টানা এক বছর পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে সে দেখতে পাবে তারাটির অবস্থান বৃত্তাকারে পরিবর্তন হয়ে আবার আগের অবস্থানেই ফিরে আসছে। যার মানে হলো, তারার ঘূর্ণন চক্রটি সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ১২ মাস। সেই হিসেবে ৬ মাসের ব্যবধানে তারাকে তার বিপরীত দিকে ঘূর্ণন চক্রের অর্ধেকাংশে দেখা যাওয়ার কথা, কিন্তু পৃথিবীও যেহেতু এই ৬ মাসের ব্যবধানে তার বিপরীত দিকে চলে যাওয়ার কারণে তারা ও পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, তাই আলোর গতিতে তারার অর্ধেকাংশে অবস্থানের দৃশ্যটি পৃথিবীতে পৌছতে কিছুটা বিলম্ব হয়। এভাবে একটি তারা মূলত কোথায় আছে এবং পৃথিবী ঘূর্ণনের ফলে তারাটিকে ঠিক কোথায় দেখা যাচ্ছে এই বিষয়টিকে জেমস ব্র্যাডলি প্রায় চার বছর পর্যবেক্ষণ করে অনেক হিসাব-নিকাশের পর তিনি বলেন, আলোর গতি হল প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩,০১,০০০ কিলোমিটার। যা বর্তমান প্রতিষ্ঠিত মানের চেয়ে প্রায় ০.৪০% তথা ১,২০৭.৫৪ কিলোমিটার বেশি ছিলো।

এরপর ১৮৪৯ সালে ফরাসি পদার্থবিদ আরমান্ড হিপোলাইট লুইস ফিজিও আলোর গতি নির্ণয়ের পরিক্ষা করেন একটি ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। তিনি এই পরিক্ষাটি করার জন্য দাঁতওয়ালা একটি চাঁকা ব্যবহার করেন, যেরকম দাঁতওয়ালা চাঁকাতে আমরা সাইকেলের চেন লাগানো থাকতে দেখি। তিনি যে চাঁকাটি ব্যবহার করেন, সেই চাঁকার দাঁতের প্রশস্ত ও দুই দাঁতের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থানের প্রশস্ত ছিলো সমান। এই দাঁত বিশিষ্ট চাঁকাটিকে তিনি এমন অবস্থানে স্থাপন করলেন, যেন সেটিকে মোটরের সাহায্যে ঘুরানো যায়। এরপর সেই চাঁকার এক পাশে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে একটি আয়না স্থাপন করলেন। অতঃপর চাঁকার অপর পাশ থেকে দুই দাঁতের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান দিয়ে আলো প্রেরণ করলেন চাঁকার অন্য পাশে স্থাপিত আয়নার উপর। যার ফলে সেই আলো আয়না দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে একই ফাঁকাস্থান দিয়ে আবার ফিরে আসে চাঁকার অপর পাশে এবং হেলানো আরেকটি আয়নার উপর প্রতিফলিত হয়ে পৌঁছে যায় একটি ডিটেক্টরে। যার ফলে যেই আলোকে চাঁকার দাঁতের ফাঁকাস্থান দিয়ে পাঠানো হয়, সেই আলোকেই আবার ডিটেক্টরে দেখা যায়।

এভাবে সবকিছুকে সঠিকভাবে স্থাপন করার পর হিপোলাইট ফিজিও একটি মোটরের সাহায্যে চাঁকাটিকে ঘোরাতে শুরু করলেন। যে কারণে দাঁতের ফাঁকাস্থান দিয়ে পাঠানো আলোকে ডিটেক্টরে দেখা যাচ্ছিলো জ্বলা-নেভা অবস্থায়। তিনি চাঁকার ঘূর্ণন গতিকে যত বেশি বৃদ্ধি করতে লাগলেন, ডিটেক্টরের আলোও ঠিক ততো বেশিই জ্বলতে-নিভতে দেখা গেলো। এভাবে চাঁকাটিকে ঘোরাতে ঘোরাতে এমন একটি গতিশীলতায় নিয়ে যাওয়া হলো, যখন আর ডিটেক্টরে কোনো আলোই দেখা যাচ্ছিলো না। কেননা, দুই দাঁতের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান দিয়ে আলো প্রবেশ করার পর তা ৮+৮=১৬ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে আবার সেই ফাঁকাস্থানে পৌছতে পৌছতে আলোর সামনে থেকে ফাঁকাস্থানটি চলে গিয়ে সেখানে চাঁকার একটি দাঁত এসে আলোকে আটকে দিচ্ছিলো। এইজন্যই সেই আলোকে ডিটেক্টরে দেখা যাচ্ছিলো না, যেহেতু আলো ডিটেক্টর পর্যন্ত পৌছেইনি।

বিষয়টি আরো সহজভাবে বোধগম্য হওয়ার জন্য ধরুন আপনার রুমে লাগানো সিলিং ফ্যানটি আপনি চালু করলেন এবং ফ্যানটি ধীরগতিতে চলা অবস্থায় একটি ক্রিকেট বল বা তারচেয়েও আরো ছোট বলকে আপনি উপর দিকে ছুড়ে মারলেন। ফলে সেই বলটি ফ্যানের দুই পাখার মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান দিয়ে গমন করে উপরের সিলিং-এর সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার সেই ফাঁকাস্থান দিয়েই বলটি এসে আপনার হাতে পড়লো। অতঃপর কিছু সময়ের ব্যবধানে যখন ফ্যানের গতি বেড়ে গেলো, তখন আপনি আবারো বলটিকে উপর দিকে ছুড়ে মারলেন। এতে কোনোক্রমে বলটি ফ্যানের পাখাকে অতিক্রম করে সিলিং পর্যন্ত পৌছে গেলেও সেখানে ধাক্কা খেয়ে আবার আপনার কাছে ফিরে আসার সময় তা ফ্যানের পাখাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে গেলো। যেকারনে বলটি আপনার হাত পর্যন্ত পৌছেনি। এবার এই কাজটিই ধরুন আপনি আলোর মাধ্যমে করতে চাইলেন। এজন্য ফ্যানটি বন্ধ করে ফ্যানের উপরে সিলিং-এর সাথে আপনি একটি আয়না লাগিয়ে নিলেন এবং আবার ফ্যানটি চালু করলেন তার সম্পূর্ণ গতিতে। এরপর একটি লেজার লাইটের আলো ফ্যানের মধ্য দিয়ে আয়নাতে প্রতিফলিত করে সেই আলোকে আবার ফ্যানের মধ্য দিয়েই নিচের ফ্লোর পর্যন্ত নিয়ে আসলেন। এতে আপনি দেখতে পেলেন ঘূর্ণায়মান ফ্যানের কারণে ফ্লোরের উপর আলোটা জ্বলতে-নিভতে শুরু করলো। অর্থাৎ, লেজারের আলোটা নির্দিষ্ট সময় পরপর হলেও ফ্লোর পর্যন্ত ফিরে আসছে। আলোর গতি যেহেতু বলের গতির চেয়েও অনেক গুণ বেশি তাই বলটি ফ্যানের মধ্য দিয়ে ফিরে না আসলেও আলো ঠিকই ফিরে আসছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, ফ্যানের গতি কম থাকাবস্থায় বলটি পুনরায় ফিরে আসলেও ফ্যানের গতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কিন্তু বলটি আর ফিরে আসেনি। ঠিক তেমনি আলোর বেগের তুলনায় ফ্যানের গতি অনেক কম থাকাবস্থায় আলো পুনরায় ফিরে আসলেও ফ্যানের গতিকে যদি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে আলো আর ফ্যানের ওপাশ থেকে ফিরে না এসে বরং তা ফ্যানের পাখাতেই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে এটি আমাদের সাধারণ ফ্যান দ্বারা সম্ভব নয়।

হিপোলাইট ফিজিও যখন দাঁতওয়ালা চাঁকাটিকে ঘোরাতে ঘোরাতে এমন একটি গতিশীলতায় নিয়ে গেলো, যখন আর আলো ডিটেক্টরে ফিরে না এসে বরং তা চাঁকার দাঁতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে গেলো তখন তিনি এই বিষয়টির উপর ভিত্তি করে আলোর বেগ নির্ণয় শুরু করে দেন। তিনি প্রথমে এটা বের করেন যে, চাঁকাটিকে ঠিক কতটুকু গতিতে ঘুরানোর ফলে প্রতিফলিত আলো বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং সেই অনুপাতে চাঁকা একবার ঘুরতে কতটুকু সময় লেগেছিল। এখান থেকে তিনি এটা বের করেন যে, একটি দাঁতের প্রশস্ত পরিমাণ স্থান পারি দিতে চাঁকার সময় কতটুকু লেগেছিল। কেননা, চাঁকার একটি দাঁতের প্রশস্ত পরিমাণ স্থান পারি দিতে সময় যতটুকু লাগবে, ১৬ কিলোমিটার স্থান পারি দিতেও আলোর ঠিক একই পরিমাণ সময় লাগবে। কেননা, চাঁকা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরের আয়না পর্যন্ত আলো পৌছার পর সেই আলো আবার চাঁকা পর্যন্ত ফিরে আসার দূরত্ব হলো ৮+৮=১৬ কিলোমিটার। যার মানে দাঁড়ায়, একটি দাঁতের প্রশস্ত পরিমাণ স্থান পারি দিতে চাঁকার যতটুকু সময় লেগেছে, ১৬ কিলোমিটার দূরত্ব পারি দিতেও আলোর ঠিক একই পরিমাণ সময় লেগেছে। অতএব একটি দাঁতের প্রশস্তকে অতিক্রম করতে সময় ঠিক কতটুকু লেগেছে এটা বের করার অর্থ হলো, ১৬ কিলোমিটার স্থান অতিক্রম করতে আলোর কতটুকু সময় লাগে সেটা নির্ণয় করে ফেলা। আর এতোটুকু নির্ণয় করা গেলে তো আলো কতটুকু সময়ে কতটুকু স্থান অতিক্রম করতে পারে সেটাও খুব সহজে বের করে নেয়া যাবে। তাই ফিজিও এক দাঁত পরিমাণ স্থান অতিক্রমের সময়টিকে বের করেন এবং তিনি বলেন যে, আলোর গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩,১৫,০০০ কিলোমিটার। হিপোলাইট ফিজিও এর পরিক্ষাটি যদিও পূর্বের তুলনায় অনেক সূক্ষ্ম ছিলো, তবুও তার নির্মিত মানটি ছিলো বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত মানের চেয়ে প্রায় ৫.১% বেশি।

এরপর ১৮৬২ সালে লিওন ফুকো ফিজিও-এর মতই একটি পরিক্ষা করে আলোর বেগ মান পান প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২,৯৮,০০০±৫০০ কিলোমিটার। তবে তিনি এই পরিক্ষাতে ঘূর্ণায়মান চাঁকার পরিবর্তে ব্যবহার করেন ঘূর্ণায়মান আয়না। ফুকোর এই পদ্ধতিকে আরেকটু উন্নতিসাধনে একটু ভিন্নভাবে পরিক্ষা করে আলবার্ট আব্রাহাম মাইকেলসন ১৯২৬ সালে আলোর বেগ পান সেকেন্ডে প্রায় ২,৯৯,৭৯৬±৪ কিলোমিটার। এভাবে আরো অনেকেই অনেকভাবে আলোর গতি পরিমাপ করে তার মান পেয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, লুইস এসেন পেয়েছিলেন ২,৯৯,৭৯২.৫±৩.০ কি.মি, কেডি ফ্রুম পেয়েছিলেন ২,৯৯,৭৯২.৫০±০.১০ কি.মি. এবং কে.এম এভেনসন পেয়েছেন ২,৯৯,৭৯২.৪৫৬২±০.০০১১ কি.মি.। এছাড়াও অন্যরা আরো অন্যান্য মানও পেয়েছিলেন। আর এপর্যন্ত যারা যারাই আলোর বেগ মান বের করেছেন তাদের প্রত্যেকের মান ছিলো কিছুটা হলেও ত্রুটিপূর্ণ। তাই আলোর বেগের সঠিক মানটি নির্ণয় করার জন্য আলোকে দৈর্ঘ্যের একক মিটার বা কিলোমিটার দ্বারা সংজ্ঞায়িত না করে মিটারকে বরং আলোর মাধ্যমে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলো এবং মিটারের এই নতুন একক দ্বারা ১৯৮৩ সালে আলোর গতি নির্ধারণ করা হয় প্রতি সেকেন্ডে ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ মিটার। যা কিলোমিটারে রূপান্তর করলে হয় ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ কি.মি.। এই মানটিকেই সর্বজন স্বীকৃত বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত প্রতি সেকেন্ডে আলোর নির্ভুল গতিবেগ হিসেবে ধরা হয়।

আপনি যদি পুরো লেখাটি পড়তে পড়তে এপর্যন্ত এসে থাকেন তবে এতক্ষণে হয়তো অবশ্যই জেনে গিয়েছেন যে, আলোর গতি নির্ণয়ের জন্য বিজ্ঞানীদের কত কিই-না করতে হয়েছে। এর জন্য দৈর্ঘ্যের একক মিটারকে পর্যন্ত নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন হয়েছে। সেই ১৬২৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশত বছর ব্যায় হয়েছে আলোর সঠিক বেগটি নির্ণয় করার জন্য। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো যেই বেগ মানটি নির্ণয় করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল সাড়ে তিনশত বছর, সেই মানটি কোরআন থেকে বের করলে সাড়ে তিন মিনিটও সময় লাগবে না। কথাটা খুব আশ্চর্যজনক মনে হলেও এটাই সত্য যে, আপনি চাইলে মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই আলোর সঠিক গতিবেগটি বের করে ফেলতে পারবেন কোরআন থেকে। আর সেটাই এখন আমরা করতে যাচ্ছি।

কোরআন থেকে আলোর গতি বের করার আগে গতিবেগ নির্ণয়ের ছোট্ট একটি গাণিতিক সূত্র সম্পর্কে আমরা পরিচিত হয়ে নিই।
সূত্র : s = d/t
সূত্রটিতে s হল গতিবেগ, d হল দূরত্ব, আর t হল সময়। সূত্রের মানে হচ্ছে, প্রদত্ত সময় দিয়ে দূরত্বকে ভাগ করলেই গতিবেগ বেড়িয়ে আসবে। অর্থাৎ, সূত্র অনুসারে কোনকিছুর গতিবেগ বের করতে হলে প্রয়োজন হবে শুধুমাত্র সময় ও দূরত্ব। বিষয়টি ঠিক কেমন তা বুঝার জন্য ধরুন আপনি কোনো একটি ট্রেনের রাস্তার পাশে বসে আছেন। হঠাৎ দেখলেন রাস্তা দিয়ে একটি ট্রেন আসছে। এখন আপনি চাচ্ছেন ট্রেনটি ঠিক কতটুকু গতিতে ছুটে চলছে তা আপনি রাস্তার পাশে বসেই জেনে নিবেন। এর জন্য আপনি যে কাজটি করতে পারেন সেটি হলো, ট্রেনটি আপনার কাছে আসার আগেই ট্রেনের রাস্তার পাশে কিছু একটা রেখে দিন এবং তার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে আরেকটা কিছু রেখে এরপর এই বস্তু দুটির একটি হতে আরেকটি পর্যন্ত পৌছতে বিশাল ট্রেনটির ঠিক কতটুকু সময় লাগে সেটা আপনার ঘড়ি বা মোবাইলের সাহায্যে নির্ণয় করুন। অতঃপর প্রদত্ত সময় দিয়ে বস্তু দুটির মধ্যবর্তী দূরত্বকে ভাগ করে দিন, তাহলেই আপনি উক্ত চলন্ত ট্রেনের গতিবেগটি পেয়ে যাবেন। আর গতিবেগ যদি আপনি পেয়ে যান তাহলে তো এটাও জেনে নিতে পারবেন যে, এই গতিতে চললে ট্রেনটি কতটুকু সময় পর কোথায় গিয়ে পৌছবে।

ট্রেনের গতি নির্ণয়ের সূত্র ধরেই এবার আমরা আলোর গতি নির্ণয় করবো কোরআন থেকে। উল্লিখিত সূত্র থেকে আমরা জানতে পারলাম, কোনকিছুর গতিবেগ নির্ণয় করতে হলে প্রয়োজনীয় উপকরণ হচ্ছে সময় ও দূরত্ব। অতএব, আলোর গতি সংক্রান্ত কোনো সময় ও দূরত্ব যদি আমরা কোরআন থেকে বের করতে পারি, তাহলে খুব সহজেই আলোর গতিবেগটি কোরআন থেকে নির্ণয় করা যাবে। আর এটাই আমরা এখন করতে চলেছি।

পবিত্র কোরআনে সূরা সাজদাহ-এর ৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর সমীপে সব কিছুই প্রত্যাবর্তিত হবে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ হবে তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান। এই আয়াত থেকেই আমরা আলোর গতিটা বের করবো। তার আগে বলে রাখি, আমরা জানি ফেরেশতারা নূর তথা আলো দ্বারা সৃষ্ট। আর আল্লাহর সকল কাজ যেহেতু ফেরেশতারাই করে থাকে, তাই উপরের আয়াতের মানে দাঁড়াচ্ছে, সবকিছু একদিন আল্লাহর সমীপে প্রত্যাবর্তিত হবে ফেরেশতাদের মাধ্যমে। আর ফেরেশতারা যেহেতু আলো দ্বারা সৃষ্ট তাই এটাও বলা যায় যে, প্রত্যাবর্তনটা হবে আলোর গতিতে। যার মানে হলো, উপরোক্ত আয়াতটিতে এই কথার ইঙ্গিত রয়েছে যে, আলো একদিনে যে পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করে, সেই দূরত্বটি হলো এক হাজার বছরের দূরত্বের সমান। অতএব, এই আয়াত থেকে যদি আমরা আলোর গতি বের করতে চাই তাহলে আমাদের প্রয়োজন হবে এক হাজার বছরের দূরত্ব ও একদিনের সময়। এর জন্য প্রথমেই তাহলে এক দিনের সময়টা বের করে নেয়া যাক। সূর্যের চারদিকে পৃথিবী তার অক্ষের উপর একবার ঘূর্ণনের সময়টাই হলো ‘একদিন’। দিনের এই একক সময়টা আমাদের নিকট ঘড়ির হিসেবে ২৪ ঘন্টা হলেও প্রকৃতপক্ষে সৌরদিনে কিছুটা কম হয়ে থাকে। যা সেকেন্ডে রূপান্তর করলে হয়, একদিন সমান ৮৬,১৬৪.০৯৯৬৬ সেকেন্ড। এখানে আমরা সময়টি পেলাম। এবার আমাদের প্রয়োজন হবে দূরত্ব।

দূরত্ব বের করার জন্য লক্ষ্য করুন আয়াতটিকে। আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের গণনায় এক হাজার বছর। আর আমরা সবাই জানি আরবি মাস ও বছর গণনা করা হয় চন্দ্রের হিসেবে। অর্থাৎ, চাঁদ পুরো পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যেটুকু সময় লাগে সেটাই হলো আরবি এক মাস এবং ১২ বার প্রদক্ষিণ করতে যেটুকু সময় লাগে সেটা হলো এক বছর। সেই হিসেবে এক হাজার বছর সম্পন্ন হতে চাঁদ ১২,০০০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে হবে। অতএব, আয়াত অনুসারে ১২,০০০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদ যে দূরত্বটি অতিক্রম করে, সেই দূরত্বটিই হলো এক হাজার বছরের দূরত্ব, যেটি অতিক্রম করতে আলোর সময় লাগে একদিন। আর এই একদিনের সময়টা যেহেতু আমাদের জানা আছে, তাই এবার যদি আমরা এটা বের করতে পারি যে, ১২০০০ বার প্রদক্ষিণের জন্য চাঁদের কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়, তাহলেই আমরা আলোর গতিবেগটি নির্ণয় করতে পারবো।

চাঁদের গড় বেগ হলো প্রতি সেকেন্ডে ১.০২২৭৯৪২৭২ কিলোমিটার এবং পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘোরে আসতে চাঁদের সময় লাগে ২৩,৬০,৫৯১.৫ সেকেন্ড। এখন এই দুটি মানের গুণফলকে যদি ১২,০০০ দিয়ে গুণ করা হয়, তাহলে চাঁদের কক্ষপথ অনুযায়ী এক হাজার বছরের দূরত্বটি পাওয়া যাবে। তবে এভাবে হিসাব করলে আমরা আসল মানটি পাবো না। কেননা, চাঁদ তার কক্ষপথে ঘোরার সময় পৃথিবীও তার কক্ষপথে ঘোরে। ফলে পৃথিবী তার স্থান থেকে কিছুটা সরে যায়। যে কারনে চাঁদের কক্ষপথেও কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। যার ফলশ্রুতিতে সূর্যের সাথে পৃথিবী ও চন্দ্র একটা ২৬.৯২৮৪৭৮১৭º কোণ তৈরি করে। এজন্য সঠিক দূরত্বটি বের করতে হলে এই কোণটিকেও হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে নিচের নিয়মেঃ-
12000×(Ve.Cosθ).T
এখানে Ve হলো চাঁদের গতিবেগ এবং T হলো তার কক্ষপথে একবার ঘূর্ণনের সময়, আর Cosθ এর মধ্যে θ(থিটা) হলো সেই কোণটি। অতএব, Cosθ হবে cos(26.92847817º)=0.8915725423
এবার এই সবগুলো মানকে একসাথে ক্যালকুলেশন করে দূরত্ব পাওয়া যাবেঃ-
12000×(Ve.Cosθ).T = 12000 × 1.022794272 × 0.8915725423 × 2360591.5
= 25,831,347,226.785 km
এটাই হলো চাঁদ ১২,০০০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার দ্বারা চন্দ্রের এক হাজার বছরের দূরত্ব।

উপরের ক্যালকুলেশনটি সাইন্স পড়ুয়া স্টুডেন্টসদের জন্য সহজভাবে বোধগম্য হলেও অন্যদের কাছে খুব কঠিন লাগতে পারে। তাই সংক্ষিপ্তাকারে এই হিসাবটির একটু বিবরণ দেয়া যাক। বলা বাহুল্য যে, চাঁদের গতি সর্বদা এক নয়। বরং, কখনো এর গতি বৃদ্ধি পায়, কখনো আবার হ্রাস পায়। তাই চাঁদের গড় গতি ধরা হয় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১.০২২৭৯৪২৭২ কি.মি.। চাঁদের এই গতি দিয়ে যদি আমরা তার কক্ষপথের দূরত্ব বের করতে চাই তাহলে সেটা মাস হিসেবে দূরত্ব হবে না। কেননা, চাঁদ যেহেতু পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবী তার নিজ স্থান হতে কিছুটা সরে যায়, তাই পূর্ণ একমাস সম্পন্ন হওয়ার জন্য প্রতিবারই চাঁদের একটু বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। আর সেই অতিরিক্ত দূরত্ব অনুযায়ী মাসের দূরত্বটি বের করার জন্য চাঁদের গড় গতির সাথে উপরে বর্ণিত কৌণিক মান থেকে পাওয়া Cosθ এর মানটি গুণ করে দিলে মাস হিসেবে চাঁদের গতি পাওয়া যায় সেকেন্ডে প্রায় ০.৯১১৮৯৫২৮৯৩ কি.মি.। তারপর এই গতির সাথে চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করার সময়কে গুণ করার ফলে এক মাসের দূরত্ব আসলো ২১,৫২,৬১২.২৬৮৮৯৮৭ কি.মি.। এখন এই একমাসের দূরত্বকে ১২,০০০ এর সাথে গুণ করার পর এক হাজার বছরের দূরত্ব পাওয়া গেলো ২,৫৮৩,১৩,৪৭,২২৬.৭৮৫ কি.মি.। এবার এই দূরত্বকে যদি এক দিনের সময় ৮৬,১৬৪.০৯৯৬৬ সেকেন্ড দিয়ে পূর্বোল্লিখিত গতিবেগ নির্ণয়ের s=d/t সূত্র অনুসারে ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে আলোর গতি পাওয়া যায় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ কিলোমিটার। যা বর্তমান প্রতিষ্ঠিত সর্বজন স্বীকৃত আলোর গতিবেগের সাথে মিল রাখে।

এখানে ভাববার বিষয়টা হলো, আলোর গতিবেগের যেই সঠিক মানটি আজ থেকে শত বছর আগেও বিজ্ঞানীদের নিকট অজ্ঞাত ছিলো, সেই মানটি আজ থেকে হাজার বছর আগেই মুসলমানদের ধর্মীয়গ্রন্থ আল-কোরআনে কিভাবে এলো? কোরআন তো কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ নয়, এটা হচ্ছে ধর্মীয়গ্রন্থ। কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকা স্বাভাবিক বিষয় হলেও কোনো ধর্মীয়গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকাটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। তা সত্ত্বেও কিভাবে এলো আলোর গতিবেগ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের এতো সুক্ষ্মতম তথ্যটি মুসলমানদের এই ধর্মীয়গ্রন্থ আল-কোরআনে? কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, যখন কিনা বিজ্ঞানের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না এবং ছিলো না কোনো বিজ্ঞানাগার। এমনকি তখনকার সময়ে কারো এটা কল্পনাতেও ছিলো না যে, আলোরও কোনো গতি থাকতে পারে। অথচ আলোর পুরো গতিবেগটিই আমরা বের করে নিয়েছি তখনকার সময়ের ধর্মীয়গ্রন্থ থেকে। অতএব, এই কোরআন যদি মনুষ্য কর্তৃক রচিত হতো, তাহলে এতে এইরকম তথ্য কিভাবে এলো যা মানুষ জানতোই না? এর দ্বারা তো এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের এই আল-কোরআন সাধারণ কোনো মানুষ দ্বারা রচিত গ্রন্থ নয়, বরং এটা হলো সর্বজ্ঞানী পবিত্র সত্ত্বা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ হতে নাযিলকৃত এমন একটি ঐশী গ্রন্থ, যা আখেরি নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মুজিযা স্বরুপ সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয়গ্রন্থ হিসেবে লাওহে মাহফুজ হতে প্রেরিত হয়েছে।

The post [কোরআন ও বিজ্ঞান] আলোর গতি যেভাবে মাপা হয়েছিল appeared first on Trickbd.com.



from Trickbd.com https://ift.tt/Bo6w5hg
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post